১. ইতিহাস ও সম্ভাবনা: সূর্য থেকে আসা বিপর্যয় (Geomagnetic Storm / Solar Flare)
১.১ Carrington Event — ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সূর্যঝড়
- ১৮৫৯ সালে রিচার্ড কারিংটন একটি সূর্যপ্রকাশ (solar flare) পর্যবেক্ষণ করেন, যা পরে “Carrington Event” নামে পরিচিত হয়।
- সেই সময় বেশিরভাগ যোগাযোগ ছিল টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা, এবং বেশ কিছু টেলিগ্রাফ লাইন ও সার্কিটে অস্বাভাবিক দূর্যোগ (sparks, আগুন) দেখা দেয়।
- সেই ঝড়ের শক্তি ও তার প্রভাব সম্পর্কে আধুনিক গবেষণায় বলা হয়েছে—যদি এমন ঘটনা আজ ঘটে, তার প্রভাব অনেক গুণ বেশি হবে, কারণ আমাদের প্রযুক্তি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।
১.২ আধুনিক পৃথিবীতে Carrington-শ্রেণীর ঝড় কী করতে পারে?
অধিকাংশ গবেষণা বলে:
-
বিদ্যুৎ গ্রিড (Power Grid) ক্ষতি
একটি Carrington-রূপের জ্যান্ত ঝড় অনেক উচ্চভোল্টেজ ট্রান্সফর্মার (power transformers) গরম করে দিতে পারে, ওভারহিট হতে পারে, এবং এমনকি ঝড়ের উত্তেজনাজনিত প্রবর্তিত ধারা (geomagnetically induced currents, GICs) পরিচালনাসামগ্রীকে বিপর্যস্ত করতে পারে।
Lloyd’s of London ও Atmospheric and Environmental Research একটি গবেষণায় বলেছে, একটি Carrington-শ্রেণীর ঝড় উত্তর আমেরিকার গ্রিডে সপ্তাহ থেকে মাস পর্যন্ত বিদ্যুৎ বন্ধ করতে পারে, যেই পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষয় হবে—অত্যন্ত বড়।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৯ সালে একটি মাঝারি জ্যো-ম্যাগনেটিক ঝড়ের কারণে কুইবেকে (কানাডা) মাত্র ~ ৯০ সেকেন্ডেই গ্রিড বন্ধ হয়ে যায়। -
ইন্টারনেট ও যোগাযোগ অবস্থা ভেঙে যেতে পারে
ভালভাবে কাজ করার জন্য যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও ডেটা সেন্টার নির্ভর করে কন্ট্রোল ও ট্রান্সমিশন লাইনে। বিশাল ধ্বংসের ফলে, মৌলিক যোগাযোগ (কোউন্ট্রোল সিগন্যাল, রাউটার, সার্ভার) বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
একটি Astronomy.com নিবন্ধ বলেছে: “A Carrington Event-size storm would be extremely damaging to the electrical and communication systems worldwide with outages lasting into the weeks.” -
GPS / ন্যাভিগেশন ও স্যাটেলাইট ক্ষতি
স্যাটেলাইটগুলোতে উচ্চ শক্তির বিকিরণ বা সূর্য থেকে আসা চার্জ কণা (charged particles) কাজ করতে পারে—সেন্সর, ইলেকট্রনিক সার্কিট এবং যোগাযোগ লিংকের মধ্যে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
যদি স্যাটেলাইট ব্যাহত হয় বা ধ্বংস হয়, GPS, গ্লোবাল পজিশনিং, সময় সমন্বয় (time synchronization) ইত্যাদিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
উদাহরণস্বরূপ, Sky at Night Magazine বলেছে: “কৃত্রিম উপগ্রহ কাজ না করলে মোবাইল নেটওয়ার্ক কল সংযোগ চালাতে পারবে না” -
শৃঙ্খল বিকল্প ব্যর্থতা (Cascading Failures)
একটি ধাপে সম্পর্কিত বিভিন্ন সিস্টেম একে অপরকে নির্ভর করে। যেমন, বিদ্যুৎ না থাকলে ডেটা সেন্টার বন্ধ হয়ে যাবে, যোগাযোগ মডেম/রাউটার বন্ধ হবে, হাসপাতাল ও পানিযুক্ত যন্ত্র কাজ বন্ধ করবে। এসব একসাথে বড় ধ্বংসের ছক তৈরি করতে পারে।
New Yorker নিবন্ধ উল্লেখ করে, “extensive damage to satellites would compromise everything from communications to national security, while extensive damage to the power grid would compromise everything: health care, transportation, …” -
অর্থনীতি ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা
শনিবার–রবিবারের সময়ে এবং দিনের পর দিনের ব্ল্যাকআউট বিশ্ব অর্থনীতি ধ্বংস করতে পারে। গবেষণায় বলা হয়েছে—উত্তর আমেরিকার ক্ষেত্রে Carrington-শ্রেণীর ঝড় অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে সপ্তাহ-হাজার কোটি ডলারের পরিমাণে।
মানবসেবা (চিকিৎসা, পানি, ইন্ধন সরবরাহ) ও লজিস্টিক সমর্থন ব্যর্থ হলে দুর্ভিক্ষ, রোগ, অরাজকতা বাড়বে।
সুতরাং, যদি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সূর্যঝড় (বা তার থেকে বড়) আজ ঘটে—তার পরিণতি হতে পারে কালের পরিক্রমায় ধ্বংসাত্মক।
২. শত্রু কৃত্রিম আক্রমণ: সাইবার ও ক্ষেপণাস্ত্র/ASAT (Anti-Satellite) অস্ত্র
কেবল প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, মানুষও প্রযুক্তি ধ্বংস করার সক্ষমতা রাখে। নিম্নবিন্দুতে কিছু মডেল ও ঘটনা তুলে ধরা হলো:
২.১ সাইবার আক্রমণ ও উপগ্রহগুলোর হ্যাক
-
Viasat-এর কেস (২০২২)
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের শুরুতে Viasat স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কে আক্রমণ চালায়। বহু মডেম প্রজ্বলিত হয় (modems remotely erased) এবং ইউক্রেনে ইন্টারনেট পরিষেবা প্রভাবিত হয়।
এ ঘটনাটি দেখায়—কোনো দেশ সরাসরি স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কে হস্তক্ষেপ করতে পারে, শুধুমাত্র সফটওয়্যার/ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে। -
সাইবার-নেটওয়ার্ক আক্রমণ উপগ্রহ সিস্টেমে
MDPI পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন সিস্টেমগুলো (telemetry, telecommand) বিভিন্ন ধরনের সাইবার আক্রমণের (Denial-of-Service, মেসেজ পরিবর্তন, সিগন্যাল জ্যামিং) ঝুঁকিতে।
LSE Ideas-তে বলা হয়েছে, সাইবার আক্রমণ দ্বারা বিশেষভাবে উপগ্রহ সিস্টেমকে লক্ষ্য করা হচ্ছে, এবং এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও ব্যবহার হচ্ছে। -
জ্যামিং (jamming) ও সিগন্যাল ব্লক করা
সিগন্যাল জ্যামিং বা হস্তক্ষেপ উপগ্রহ থেকে পাওয়া সংকেতকে বিকৃত করতে পারে। একটি গবেষণা “Intermittent Jamming against Telemetry and Telecommand of Satellite Systems” এ এমন হামলার ধরন ও সনাক্তকরণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
২.২ ক্ষেপণাস্ত্র / ASAT অস্ত্র দ্বারা ধ্বংস
- চীনের ২০০৭ এ ASAT পরীক্ষা
২০০৭ সালে চীন FY-1C (উপগ্রহ) ধ্বংস করে একটি ক্ষেপণাস্ত্র চালায়। এতে অনেক ধ্বংসাবশেষ (space debris) তৈরি হয়। - রাশিয়ার Kosmos 1408 ধ্বংস (২০২১)
রাশিয়া নিজস্ব Anti-Satellite (A-235 “Nudol”) অস্ত্রের মাধ্যমে Kosmos 1408 উপগ্রহ ধ্বংস করে, এবং এর ধ্বংসাবশেষ আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। - ESPI রিপোর্ট
ESPI (European Space Policy Institute) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—কোনো রাষ্ট্র যদি একটি স্যাটেলাইট ধ্বংস করে তবে ধ্বংসাবশেষ পরিবাহী হবে এবং অনেক সময় পুরো কক্ষপথগুলোকে বিপজ্জনক করে দিতে পারে। - ক্লাসিকাল গবেষণা (Kallberg, ২০১২)
“Designer Satellite Collisions from Covert Cyber War” গবেষণায় বলা হয়েছে, একটি রণকৌশলগত উপগ্রহ ধ্বংস হলে ধ্বংসাবশেষ অন্যান্য কার্যকর স্যাটেলাইটের জন্য আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
৩. সম্ভাবনা ও বর্ধিত ঝুঁকি
যদিও “সর্ব প্রযুক্তি হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার” পুরোপরি সম্ভাবনা কম, কিন্তু নিম্নলিখিত ঝুঁকি ও প্রবণতা রয়েছে:
৩.১ সূর্যঝড়ের সম্ভাবনা
- গবেষণা বলছে, Carrington-রূপের একটি ঝড় প্রতি ১০০–১০০০ বছরে একবার আসতে পারে।
- The Planetary Society এবং অন্যান্য উৎস বলছে যে, বর্তমান সান সাইকেল ও সক্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে ঝড়ের সম্ভাব্যতা কিছুটা বেশি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
- ITU (International Telecommunication Union) বলছে, একটি Carrington-রূপের ঝড় আজ ঘটলে উচ্চভোল্টেজ ট্রান্সফর্মার গরম হয়ে যেতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি ব্ল্যাকআউট হতে পারে।
৩.২ মানুষসৃষ্ট আক্রমণের সম্ভাবনা
- বর্তমান বিশ্বের গ্লোবাল প্রক্রিয়াগুলি যোগাযোগ ও সাইবারভিত্তিক। এইভাবে, সাইবার যুদ্ধ বা রাষ্ট্রীয় হ্যাকিং–আক্রমণ থেকে ধ্বংসের সম্ভাবনা সুদৃঢ়।
- প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে স্যাটেলাইট জ্যামিং ও সাইবার হুমকি ঘটছে।
- রাষ্ট্রগুলো ASAT বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি অর্জন করছে—যাতে তারা অন্য দেশের উপগ্রহ ধ্বংস করতে পারে।
৩.৩ রদবদল ও প্রস্তুতি
- অনেক দেশ ও সংস্থা “space weather prediction,” “satellite hardening,” ও “electrical grid resilience” বিষয়ে কাজ করছে।
- কিছু দেশ তাদের পাওয়ার গ্রিড ও গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাকে “isolated microgrid” বা “off-grid fallback system” হিসেবে পরিকল্পনা করছে।
- তবে, পুরো বিশ্বব্যাপী সব সিস্টেম একসাথে ধ্বংস হলে—পুনরুদ্ধার সময় ও সম্পদ সীমাবদ্ধ হবে, এবং ধ্বংসের চক্রান্তকে পুরোপুরি প্রতিহত করা কঠিন হবে।
৪. বিশ্লেষণ ও সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
- “সব কিছু হারিয়ে যাওয়া” একটি চরম ধরনের রূপকভাবে ধরা যেতে পারে — প্রকৃতভাবে, ধ্বংস হয় যে অংশগুলো প্রযুক্তির অবকাঠামোর অত্যন্ত সংবেদনশীল অংশ, সেগুলো।
- সমাজ যে বিভিন্ন স্তরে বিভাজিত—সরকার, বাজার, নাগরিক, সামরিক—প্রত্যেকটির ধ্বংস ও পুনর্গঠন ভিন্ন হবে। অনেক অংশ আবার অনভিজ্ঞভাবে “প্রাক-প্রযুক্তি” যুগে ফিরে যাবে।
- ধর্ম, নৈতিকতা ও সহযোগিতা আবার মানুষের মধ্যে প্রবলভাবে ফিরে আসতে পারে — যেমন অনেক ইসলামি ভবিষ্যদ্বাণী ও ধর্মগ্রন্থে বলা আছে, বড় দুর্যোগের পরে মানুষ সরল জীবন ও ঈমানের দিকে ফিরবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Heartfelt Thanks for your valuable comments.