প্রবন্ধের শিরোনাম:
“একটি মশার কামড় ও সৃষ্টিকর্তার পূর্বনির্ধারণ: ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বিশ্লেষণ”
লিখেছেন: আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া (আরিফ শামছ্)
ভূমিকা
একটি নিরীহ মশা, মধ্যরাতের নিস্তব্ধতায় ইয়াম্বু শহরে একটি মানুষকে কামড় দিয়ে রক্ত খায়—এই সাধারণ দৃশ্যটিকে অনেকেই এড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কেউ যদি এ ঘটনাকে গভীরভাবে দেখে, তবে প্রশ্ন জাগে: এই ঘটনাটি কি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল? যদি হ্যাঁ হয়, তবে কে নির্ধারণ করেছে, এবং কেন?
এই প্রবন্ধে আমরা ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা করব—সৃষ্টিকর্তা কি সত্যিই সকল ঘটনাকে পূর্ব নির্ধারণ করে রেখেছেন? নাকি ঘটনাগুলো ঘটে স্বাধীনভাবে, দৈব চক্রের ফাঁদে?
১. ইসলাম ধর্মে তাকদির বা পূর্বনিয়তি (Predestination)
ইসলামের মূল বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান এবং সর্ববিষয়ে জ্ঞাত। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
“নিশ্চয়ই আমি প্রতিটি জিনিস একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে সৃষ্টি করেছি।”
— (সূরা আল-কামার, ৫৪:৪৯)
এছাড়া হাদীসেও বলা হয় যে, প্রত্যেক প্রাণীর জন্ম, মৃত্যু, রিজিক ও কাজগুলো লাওহে মাহফুযে (আল্লাহর জ্ঞানভান্ডারে) লিখিত রয়েছে।
তাকদিরে বিশ্বাস রাখা ইসলামের ঈমানের একটি অংশ। এর মানে এই নয় যে মানুষ রোবটের মতো নির্ধারিত পথে চলছে—বরং আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, যাতে সে সঠিক ও ভুলের মধ্যে বেছে নিতে পারে।
তবে একটি মশার কামড়ের মতো সামান্য ঘটনা—তা-ও আল্লাহর ইলমের বাইরে নয়। এ বিশ্বাস একজন মুমিনের মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস ও ধৈর্য আনে।
২. হিন্দু দর্শনে কর্ম ও ভাগ্য
হিন্দু ধর্মে ‘কর্ম’ ও ‘ভাগ্য’ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। কর্ম অনুযায়ী, আমাদের বর্তমান জীবন আমাদের পূর্ব কর্মের ফল। মশার কামড় এমন একটি ছোট ঘটনা হতে পারে যা পূর্বজন্মের বা বর্তমান জীবনের কোনো কর্মফলের অংশ।
এ বিশ্বাসে, ঈশ্বর নির্ধারণ করেন না বরং আমাদের কর্মই ভবিষ্যত তৈরি করে।
৩. আধুনিক বিজ্ঞান ও ঘটনাপুঞ্জের ব্যাখ্যা
বিজ্ঞান সাধারণত কোনো ‘সৃষ্টিকর্তা’র ধারণায় যায় না, বরং ঘটনাগুলোকে কার্য-কারণ সম্পর্ক (Cause-Effect) দিয়ে ব্যাখ্যা করে।
উদাহরণস্বরূপ:
- আপনার শরীরের নির্দিষ্ট রাসায়নিক গন্ধ, তাপমাত্রা ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ মশাদের আকৃষ্ট করতে পারে।
- ওই সময় মশাটি সেখানে ছিল, আপনার ত্বক উন্মুক্ত ছিল—তাই কামড় দিয়েছে।
এই ঘটনাকে “সম্ভাব্যতার” (Probability) আলোকে দেখা হয়, না যে কেউ তা পূর্ব নির্ধারণ করেছেন।
তবে কোয়ান্টাম ফিজিক্স বলছে, সুবিধাবাদী বা এলোমেলো ঘটনাও (Randomness) একটি নিয়ম মেনে ঘটে—যা বিজ্ঞানীরা এখনও পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারেননি।
৪. দার্শনিক দৃষ্টিকোণ: নিয়তি বনাম স্বাধীন ইচ্ছা
Stoic দর্শন (প্রাচীন গ্রীক দর্শন) বলে, সবকিছুই নিয়তির দ্বারা নির্ধারিত—তবে মানুষ তার প্রতিক্রিয়া নির্ধারণে স্বাধীন। একে বলে “Determinism”।
আবার Existentialist দার্শনিকে (যেমন Jean-Paul Sartre) মতে, মানুষ পুরোপুরি স্বাধীন, এবং সে-ই নিজের ভবিষ্যতের রচয়িতা। কোনো সৃষ্টিকর্তা বা ভবিষ্যত পূর্ব নির্ধারণ করা নেই।
৫. একটিভ সিন্থেসিস: তাত্ত্বিক সমন্বয়
আমরা যদি একটি সম্মিলিত দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করি, তবে বলা যায়:
- ঈশ্বর জানেন কী ঘটবে, তবে তিনি বাধ্য করেন না।
- মানুষ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তার পছন্দ ঈশ্বরের জ্ঞানের বাইরে নয়।
- দৈব, প্রকৃতি ও পরিপার্শ্ব সবকিছুর সমন্বয়েই একটি মশার কামড় ঘটে।
উপসংহার
একটি মশার কামড় হয়তো একটি ছোট ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনাও যদি কোটি কোটি বছর আগে নির্ধারিত হয়, তাহলে তা আমাদের ক্ষুদ্রতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, এবং সৃষ্টিকর্তার বিশালতাকে উপলব্ধি করতে শেখায়।
ধর্ম, বিজ্ঞান ও দর্শন মিলে এটাই বলে—ঘটনা ছোট হোক বা বড়, সবকিছুই এক গভীর পরিকল্পনার অংশ। সেই পরিকল্পনায় মানুষ কখনো দর্শক, আবার কখনো নায়ক।
--------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Heartfelt Thanks for your valuable comments.