- আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
"ভালোবেসে ভুলা যায়? বলিবো কাহারে!!!" — এই লাইনটা যেন আরিফের বুকের চিৎকার।
আপনি যেভাবে প্রেম আর ভালোবাসার পার্থক্য টেনেছেন, আর তাতে নিজের জীবনকথা ঢেলে দিয়েছেন—এটা নিছক কবিতা না, একরকম আত্মদহন।
তাকে না পাওয়ার ব্যথা, স্মৃতির আকুলতা, প্রেমের সেই পরিণতি না পাওয়া যন্ত্রণা—সবই গভীরভাবে ফুটে উঠেছে।
এটা এমন এক কবিতা, যা হয়তো সওগাত কখনো পড়বে না, কিন্তু যে কেউ পড়বে, সে বুঝবে—এটা কেবল লেখার জন্য লেখা হয়নি, এটা এক জীবনের দলিল।
ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ: প্রেম আর ভালোবাসা — আরিফ শামছ্
১. কাব্যিক বিশ্লেষণ:
“প্রেম আর ভালোবাসা” কবিতাটি মানব হৃদয়ের সবচেয়ে কোমল, গভীর ও জটিল অনুভব—প্রেম এবং ভালোবাসার দ্বৈত রূপকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। কবি প্রথমেই এক মোহময় আবহ সৃষ্টি করেন:
“দৃষ্টির সীমানায়, হৃদয়ের মোহনায়,
কে এলো? কে যায়?”
এখানে প্রেমের আবির্ভাবকে একটি অলৌকিক এবং স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখানো হয়েছে—জান্নাতী সমীরণের সাথে বাসনার ঢেউ মিলেমিশে এক মনোলুব্ধ চিত্র আঁকা হয়েছে।
২. ছান্দসিক ও মাত্রাগত বিশ্লেষণ:
কবিতাটি মুক্তছন্দে রচিত, অর্থাৎ নির্দিষ্ট মাত্রা বা অক্ষরবিন্যাসের নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। ছন্দ রয়েছে, তবে সেটি স্বতঃস্ফূর্ত, আবেগ-নির্ভর।
অন্ত্যমিল কিছু স্থানে রক্ষিত হয়েছে (যেমন: “আহ্বান – আনচান”, “যায় – ধায়”, “আহারে – কাহারে”), যা কাব্যরসকে গীতিময় করে তোলে।
প্রতিটি স্তবকে (স্ট্যানজা) ৩-৪ পংক্তির গঠনে গঠিত, ফলে পাঠক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
৩. সাহিত্যিক দিক ও অলংকার ব্যবহার:
কবিতাটিতে প্রচুর অনুপ্রাস, রূপক, ও উপমা ব্যবহৃত হয়েছে:
রূপক: “জান্নাতী সমীরণ”, “চঞ্চলা দোল”, “তৃষ্ণায় ছটফটে মন”—এই শব্দগুচ্ছগুলো প্রেমের অভিব্যক্তিকে আবেগ ও সৌন্দর্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে।
উপমা: “হৃদয়ের মোহনায়” — প্রেমকে যেন নদীর মোহনার মতো এক সঙ্কটে, সংমিশ্রণে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এছাড়া, পুরো কবিতায় রয়েছে এক ধ্রুপদী প্রেম-ভাবনার সুর, যেখানে প্রেম শুধু শরীরী নয়, বরং আত্মিক, মানসিক ও চিরন্তন।
৪. রসাস্বাদন (রসতত্ত্ব):
এই কবিতায় একাধিক রসের উপস্থিতি লক্ষণীয়:
শৃঙ্গার রস: প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনের আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসার প্রকাশ এবং দৃষ্টি-সংযোগের মধ্য দিয়ে এর প্রতিফলন ঘটেছে।
কারুণ্য রস: একতরফা প্রেম, বিরহ, অশ্রু, যন্ত্রণা এবং না-পাওয়া ভালোবাসার বেদনায় এই রস প্রবাহিত।
“ভালোবেসে ভুলা যায়?
বলিবো কাহারে!!!”
“হৃদয়ের গভীরে,
দগদগে ক্ষত দিয়ে,
ঝরে কতো রক্ত,
দেখাবো কী করে!!!”
এই পঙ্ক্তিগুলো প্রেমের গভীর যন্ত্রণা ও আত্মিক রক্তক্ষরণ তুলে ধরে।
৫. কবিতার প্রেক্ষাপট:
এই কবিতাটি রচিত হয়েছে মদীনায়, ২০২৪ সালের ১ জুন, যা প্রবাস জীবনের আবহকে তুলে ধরে। প্রবাসের একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতা এবং স্মৃতিবিজড়িত প্রেম—এই প্রেক্ষাপটে প্রেম আরও মরমি ও বেদনাময় হয়ে ওঠে।
৬. সমালোচনা ও পর্যালোচনা:
শক্তি:
প্রেম-ভালোবাসার দ্বৈত সম্পর্ক ও বিভাজন সুন্দরভাবে তুলে ধরা।
ভাবপ্রবণ ও পাঠকের আবেগে সাড়া জাগানো ক্ষমতা।
প্রবাসের মাটি থেকে লেখা হলেও বাংলা ভাষার আবেগ বহমান।
সীমাবদ্ধতা:
কোথাও কোথাও অতি-আবেগপ্রবণতা কবিতার গভীরতা ও ভারসাম্যকে হালকা করে ফেলে।
ছন্দের অনিয়মিততা কিছু পাঠকের কাছে অসুবিধাজনক হতে পারে।
৭. মানব জীবনে তাৎপর্য ও গুরুত্ব:
এই কবিতাটি প্রেমের দুইটি ভিন্নরূপ—প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি—উভয় দিককে তুলে ধরে আমাদের জীবনের বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যকার দ্বন্দ্ব তুলে ধরে। ভালোবাসা যেমন আত্মার প্রশান্তি দেয়, তেমনই বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে অন্তরলে রক্তক্ষরণ। প্রেম কখনো তৃপ্তি, কখনো তৃষ্ণা।
এই কবিতা সেইসব মানুষের জন্য—যারা ভালোবেসে হৃদয়ের গভীরে দগ্ধ হয়েও নীরবে “একবার” ভালোবাসার আশায় বাঁচে।
✅ উপসংহার:
“প্রেম আর ভালোবাসা” কেবল একটি কবিতা নয়, বরং প্রেমের মনস্তাত্ত্বিক যাত্রার একটি দলিল। এটি যেন প্রেমিক হৃদয়ের ডায়েরির পাতা। আরিফ শামছ্ এর সহজ-সরল শব্দে লেখা কবিতাটি প্রেমিক পাঠকের কাছে গভীর আবেদন সৃষ্টি করে। ভালোবাসার নিরব আহ্বান এই কবিতার প্রতিটি পংক্তিতে জেগে থাকে।
প্রেম আর ভালোবাসা
___আরিফ শামছ্
দৃষ্টির সীমানায়, হৃদয়ের মোহনায়,
কে এলো? কে যায়?
জান্নাতী সমীরণে, বাসনার ঢেউ ধায়,
চঞ্চলা দোল খায়।
আঁখি দ্বয় তৃপ্ত,অশ্রুতে শিক্ত,
চঞ্চল প্রাণ-মন,
কোন কিছু স্থির নেই,
অস্থির, আনমন।
নাওয়া খাওয়া ভূলে যায়,
চিন্তার শেষ নাই,
সব কিছু এলোমেলো,
নিজেদের ভুলে হায়!
প্রণয়ী চারিপাশে
বারবার দেখা পায়,
কম্পিত মন খুঁজে,
সবকিছু বলি তারে,
কথা লিখে কবিতায়,
ইংগিতে আকারে।
সায় পেলে হবে প্রেম,
না হয় ভালোবাসা।
দু'জনে দু'জনার,
মিলে মিশে একাকার,
সবকিছু হরষে,
ফিরে পায় বারবার।
সুখে সুখ অবিরাম,
জান্নাতী প্রেমে পায়,
মিলেমিশে দুজনের,
জীবনের অভিপ্রায়।
প্রেম রয় কখনো
ইতিহাসের ভাঁগাড়ে,
একপেশে ভালোবাসা,
আজীবন আহারে!
ভালোবেসে ভুলা যায়?
বলিবো কাহারে!!!
মেনে যায় কতোবার,
ভাগ্যের সীমানা,
তুমি কারো হতে পারো,
মন কভু মানেনা।
জানিনা মন তব,
করে কীনা আনচান,
তৃষ্ণায় ছটফটে,
নীরবে আহ্বান।
হৃদয়ের গভীরে,
দগদগে ক্ষতদিয়ে,
ঝরে কতো রক্ত,
দেখাবো কী করে!!!
দু-জনে নির্জনে,
দুঃখে যাতনায়,
আকাশের পানে চাও,
নিবেদন প্রার্থনায়।
উদাসীন নীরবে,
দগ্ধ বারবার,
ভালোবাসা দুজনেই,
চায় শুধু একবার।
০১/০৬/২০২৪ খ্রীঃ
মদীনা,
সউদী আরব।