শুক্রবার, জুন ২৭, ২০২৫

সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি

অধিকাংশ শিক্ষিত ছেলেরা আজ বেকার, সম্মানজনক কোনো পেশা পাচ্ছে না, প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করে জীবন অতিবাহিত করতেও হিমশিম খাচ্ছে”—এই সমস্যাটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এক গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি।

🔍 সমস্যার মূল কারণসমূহ:
১. শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে অমিল
পাঠ্যক্রম এখনও অনেকটাই মুখস্থভিত্তিক, বাস্তব জীবনের চাহিদা বা বাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার ঘাটতি: প্রোগ্রামিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, AI, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ওয়ার্কশপ স্কিল ইত্যাদি শেখার সুযোগ কম।

২. সরকারি চাকরির প্রতি অতিনির্ভরতা
শিক্ষিত যুবকদের বড় অংশ শুধুমাত্র সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছে।

এতে করে সময়, বয়স, আত্মবিশ্বাস ও শক্তি—সবকিছু হারায়।

৩. ব্যবসায়িক মনোভাবের অভাব
পরিবার, সমাজ বা শিক্ষাব্যবস্থা ব্যবসাকে ‘নিঃস্বজন’, ‘অনিশ্চিত’ ও ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে মানে, ফলে তরুণেরা আত্মনির্ভরতা গড়তে ভয় পায়।

৪. টেকসই উদ্যোক্তা পরিবেশের অভাব
সহজে ঋণ, প্রশিক্ষণ বা ব্যবসায়িক সহায়তা পাওয়ার ব্যবস্থা নেই।

ঘুষ-দুর্নীতি ও প্রশাসনিক জটিলতা।

৫. মানসিক সংকট ও আত্মবিশ্বাসহীনতা
দীর্ঘ সময় বেকার থেকে হতাশা, অবসাদ ও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।

✅ সম্ভাব্য সমাধানসমূহ:
১. দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষার সম্প্রসারণ
মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরেই স্কিল ডেভেলপমেন্ট কোর্স বাধ্যতামূলক করা (যেমন: ডিজিটাল মার্কেটিং, ফ্রিল্যান্সিং, ভোকেশনাল ট্রেড)।

প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে ১টি কারিগরি ইনস্টিটিউট স্থাপন।

২. স্বনির্ভরতা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ
গৃহঋণ, স্টার্টআপ লোন, ট্রেনিংসহ উদ্যোক্তা প্যাকেজ চালু করা।

বিশেষ করে যুবকদের জন্য “১০০ দিনের ব্যবসা শিক্ষা” কর্মসূচি।

৩. সম্মানজনক পেশার সংজ্ঞা বদলানো
যে কেউ নিজের আয় দিয়ে পরিবার চালাতে পারছে, সেটাই সম্মানজনক পেশা—এই দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

শিক্ষিত রাইডার, চাষি, দোকানদার বা ডিজিটাল মার্কেটার—সবাইকে সামাজিক মর্যাদা দিতে হবে।

৪. বিদেশমুখী শ্রমের আধুনিকীকরণ
শিক্ষিত তরুণদের জন্য মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, জাপান, কোরিয়া প্রভৃতি দেশে প্রশিক্ষণসহ চাকরি নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে স্কিলভিত্তিক রপ্তানি কার্যক্রম চালু করা।

৫. মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা ও ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং
প্রতিটি কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে “ক্যারিয়ার হেল্প ডেস্ক” এবং অনলাইন কাউন্সেলিং চালু করা।

📍 শেষ কোথায়?
এই সংকটের শেষ হবে তখনই, যখন—

আমরা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে চাকরি না ভেবে “জীবন পরিচালনার ক্ষমতা” হিসেবে দেখবো।

তরুণরা চাকরিপ্রার্থী না হয়ে চাকরিদাতা হওয়ার সাহস পাবে।

পরিবার ও সমাজ প্রথাগত চাকরির বাইরের পেশাকেও সম্মান জানাবে।

সরকার ও বেসরকারি খাত মিলে দক্ষতা, উদ্ভাবন ও উদ্যোগের ভিত্তিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।

📌 উপসংহার:
এই সংকটের সমাধান রাতারাতি হবে না। তবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র মিলেই এটি মোকাবিলা করা সম্ভব।
 ---------------------------------------------------------------------- 

🔰 প্রবন্ধ:
“বেকার শিক্ষিত তরুণ: সংকটের কারণ, করণীয় ও ভবিষ্যৎ দিশা”
✍️ আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া (আরিফ শামছ্)

🔷 ভূমিকা
আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো—শিক্ষিত যুবসমাজের বেকারত্ব। বিসিএস বা ব্যাংক জবের স্বপ্ন নিয়ে হাজার হাজার তরুণ দিন পার করে দেয়, অথচ বাস্তবে হাতে মেলে না কোনো সম্মানজনক কর্মসংস্থান। পরিবার, সমাজ, এমনকি নিজের কাছেও সে একসময় অপারগ, অযোগ্য ও ব্যর্থ বলে মনে করে। তাহলে এই বিপুল শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর এই করুণ পরিণতির দায় কার?

🔷 সমস্যার মূল কারণ
১. শিক্ষার সঙ্গে জীবনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন
বর্তমান পাঠ্যক্রমে বাস্তব জীবনের দক্ষতা শেখানো হয় না। আমরা শিখি মেমোরাইজ করে পাশ করতে, কিন্তু শিখি না কিভাবে আয় করতে হয়।

২. সম্মানজনক পেশা মানেই চাকরি—এই ভ্রান্ত ধারণা
অনেকেই মনে করেন সরকারি চাকরিই সবচেয়ে সম্মানজনক। ফলে ব্যবসা, ফ্রিল্যান্সিং, কৃষি, অনলাইন কাজকে ছোট করে দেখা হয়।

৩. দক্ষতার অভাব
যুবকরা বই পড়ে ডিগ্রি নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কাজের স্কিল নেই। হাতেকলমে কিছু জানে না। বিদেশে যাওয়ার সুযোগও মিস করে।

৪. ক্যারিয়ার গাইডেন্স ও প্রেরণার ঘাটতি
স্কুল, কলেজ বা পরিবারের কেউ কখনো বলে না, “তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, সাহস রাখো।” ফলে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।

🔷 করণীয় ও সমাধান
✅ ১. দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা
মাধ্যমিক স্তর থেকে কারিগরি, ডিজিটাল, প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার সংযোজন জরুরি।

সব উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করতে হবে।

✅ ২. শিক্ষিত তরুণদের উদ্যোক্তা বানাতে হবে
ছোট ব্যবসা বা স্টার্টআপে ০% সুদে লোন, পরামর্শ ও সহযোগিতা দিতে হবে।

কলেজেই “উদ্যোক্তা গঠন কোর্স” চালু হতে পারে।

✅ ৩. “পেশা”র সম্মানজনক সংজ্ঞা বদলাতে হবে
শুধুমাত্র চাকরি নয়, নিজের আয়ে চলতে পারাটাও বড় সম্মান।

একজন ফুড ডেলিভারি রাইডার, অনলাইন উদ্যোক্তা, বা কৃষিজীবীকে সম্মান দিতে হবে।

✅ ৪. সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে কর্মসংস্থান তৈরি
সরকার চাকরি দিতে না পারলেও, কর্মসংস্থানের পরিবেশ গড়ে দিতে পারে।

প্রাইভেট কোম্পানিগুলো যেন প্রশিক্ষিত ছেলেদের অগ্রাধিকার দেয়, তার জন্য নীতিমালা দরকার।

✅ ৫. মানসিক স্বাস্থ্য ও প্রেরণা
আত্মহত্যার হার বাড়ছে হতাশ তরুণদের মধ্যে। এজন্য কাউন্সেলিং, অনুপ্রেরণামূলক সেশন, অনলাইন সাপোর্ট চালু করা দরকার।

🌍 বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যান:
🔹 বিশ্বে শিক্ষিত বেকারত্বের গড় হার (2024):
৮–৯%, তবে কিছু দেশে ১৫%-এর বেশি

🔹 যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত বেকারত্ব:
দেশ শিক্ষিত বেকারত্ব হার
ভারত ১৯–২০% (বিশ্বে অন্যতম বেশি)
দক্ষিণ আফ্রিকা ৩১–৩৫%
ফ্রান্স ও স্পেন ১২–১৫%
মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ ১৫–২৫% (বিশেষ করে জর্ডান, টিউনিসিয়া)

🔹 পশ্চিমা দেশগুলোর চিত্র:
যেমন জার্মানি, নেদারল্যান্ডস বা জাপান—এখানে শিক্ষার সঙ্গে স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও ইন্ডাস্ট্রি কানেকশন থাকায় শিক্ষিত বেকারত্ব কম (৪% এর নিচে)।

📈 একটি তুলনামূলক চিত্র (সংক্ষেপে):
বিষয়              বাংলাদেশ               বিশ্ব (গড়)
সার্বিক বেকারত্ব ~৪.২%         ~৫–৬%
শিক্ষিত তরুণ বেকার ~১২–১৩% ~৮–৯%
 
🔷 শেষ কথা: আলোর পথ কোথায়?
এই সমস্যা চিরস্থায়ী নয়। সমাধান আছে, পথও আছে—শুধু আমাদের মানসিকতা ও কর্মপদ্ধতির পরিবর্তন দরকার।
যখন—

একজন রাইডার বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে "মানুষ" হিসেবে সম্মান করা হবে,

যখন তরুণরা ভয় না পেয়ে সাহস নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে,

যখন শিক্ষা হবে শুধু ডিগ্রির জন্য নয়, জীবন ও আয়ের জন্য,
তখনই বেকার শিক্ষিত ছেলেরা হবে আগামী দিনের সফল উদ্যোক্তা, ডিজিটাল ওয়ার্কার, সমাজের পথপ্রদর্শক।

তরুণদের শুধু চাকরি নয়, প্রয়োজন সুযোগ—স্বপ্ন দেখার ও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।
আর আমাদের দায়িত্ব—তাদের সেই পথটা দেখিয়ে দেওয়া।
__________

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Heartfelt Thanks for your valuable comments.

ভালবাসি দিবা-নিশি _সূচীপত্র

কপিরাইট আইন: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, লঙ্ঘনের কারণ, সমস্যা ও সমাধান

📄 প্রবন্ধ শিরোনাম: “কপিরাইট আইন: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, লঙ্ঘনের কারণ, সমস্যা ও সমাধান” ✍️ লেখক: আরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া (আরিফ শামছ)...